‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত অঞ্চলটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরাংশে অবস্থিত একটি সংকীর্ণ ভৌগোলিক করিডোর, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যকে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে। বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল এবং চীনের নিকটবর্তী হওয়ায় এটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চিকেন নেক কী?
চিকেন নেক করিডোর, যাকে সিলিগুড়ি করিডোর বলা হয়, হলো ভারতের একটি ভৌগোলিক সংকীর্ণ অঞ্চল।
প্রস্থ: সবচেয়ে সংকীর্ণ জায়গায় এর প্রস্থ মাত্র ২২ কিলোমিটার।
অবস্থান: উত্তরে ভুটান এবং দক্ষিণে বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত।
কৌশলগত গুরুত্ব
১. উত্তর-পূর্ব ভারতের সংযোগস্থল: ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্য (যেমন: আসাম, মেঘালয়, মণিপুর) এই করিডোরের মাধ্যমে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।
২. বাংলাদেশের নিকটবর্তীতা: বাংলাদেশের সঙ্গে করিডোরটির সীমান্তবর্তী অবস্থান দুই দেশের মধ্যকার ভৌগোলিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
3. আন্তর্জাতিক সীমান্ত: করিডোরটি চীন এবং নেপালের সঙ্গেও বেশ কাছাকাছি, যা এই অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও সংবেদনশীল করে তোলে।
সামরিক ও নিরাপত্তাগত দৃষ্টিভঙ্গি
চিকেন নেক করিডোর ভারতের জন্য সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক: ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর থেকে করিডোরটি ভারতের জন্য একটি “নাজুক অঞ্চল” হিসেবে বিবেচিত।
নিরাপত্তা ঝুঁকি: এর ভৌগোলিক সংকীর্ণতা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর নিকটবর্তীতা করিডোরকে সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন একটি অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে।
বাংলাদেশের জন্য গুরুত্ব
চিকেন নেক করিডোর বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
বাণিজ্যিক সুবিধা: বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ট্রানজিট সুবিধা ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সীমান্ত সম্পর্ক: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলবন্দর এবং রেল যোগাযোগ উন্নয়নে এই করিডোর ভূমিকা রাখে।
বাণিজ্য ও পরিবহন
চিকেন নেক করিডোরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট চুক্তি: করিডোরটি ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ।
আন্তর্জাতিক করিডোর পরিকল্পনা: ভুটান, নেপাল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে আঞ্চলিক সংযোগ বাড়ানোর জন্য করিডোরটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
চিকেন নেকের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
১. ভৌগোলিক নাজুকতা: সংকীর্ণতার কারণে যেকোনো সামরিক বা রাজনৈতিক সংঘাতে এটি সহজে বিচ্ছিন্ন হতে পারে।
২. সীমান্ত সমস্যা: পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যা করিডোরের নিরাপত্তাকে জটিল করে তোলে।
৩. চীনের ভূমিকা: চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এবং তার “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” করিডোরকে কৌশলগত দিক থেকে আরও সংবেদনশীল করেছে।
উন্নয়ন ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
ভারত সরকার চিকেন নেক করিডোরের উন্নয়ন এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
সড়ক ও রেল যোগাযোগ: নতুন সড়ক ও রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে করিডোরের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করা হচ্ছে।
সীমান্ত পর্যবেক্ষণ: নিরাপত্তা জোরদার করতে সীমান্তে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
চিকেন নেক করিডোর শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামরিক ভারসাম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি দুই দেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত। করিডোরের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা শুধু ভারত নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।