সশস্ত্র আন্দোলনের মুখে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ও তাঁর রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর সিরিয়ায় জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন বিদ্রোহী সংগঠন এইচটিএসের নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি। বিজয় ভাষণে তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। নতুন সরকার অতি দ্রুত কাজ শুরু করবে জানিয়ে তিনি বলেন, এ অঞ্চলে এটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এদিকে মস্কোতে সিরিয়ার দূতাবাসে বিদ্রোহীদের নতুন পতাকা ওড়াতে দেখা গেছে। সূত্র জানায়, সিরিয়ার নতুন প্রশাসন প্রকৌশলী ও রাজনীতিক মোহাম্মদ আল বশিরকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী করতে যাচ্ছে। তাঁর নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন করা হবে।
আসাদ সরকারের পতনে গতকাল সোমবারও দামেস্কসহ বিভিন্ন শহরে উল্লাস করেন দেশটির বাসিন্দারা। দায়ের আতিয়াহ এলাকায় আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদের বিশাল মূর্তি গুঁড়িয়ে দেয় উচ্ছ্বসিত জনতা। শহরগুলোর রাস্তায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা নেচে-গেয়ে আনন্দ করেন।
যার হাত ধরে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ইস্পাত কঠিন শাসনের অবসান হয়েছে, সেই আল-জুলানি দুই দশক আগে ছিলেন আল-কায়দার যোদ্ধা। পরে তিনি ওই ভাবাদর্শ থেকে সরে হায়াত তাহরির আল-শাম বা এইচটিএস গঠন করেন। একটু সময় নিয়ে বিজয়ের এক দিন পর সোমবার তিনি ভাষণ দেন। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে সিএনএন জানায়, আল-জুলানির ওই ভাষণে রয়েছে বিভিন্ন পক্ষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। কোনো টেলিভিশনে নয়, সদ্য খালি হওয়া প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ বা কোনো মঞ্চও নয়, রাজধানী দামেস্কের ঐতিহ্যবাহী উমাইয়াদ মসজিদে বসে তিনি বিজয়ের ভাষণ দেন। এক হাজার ৩০০ বছরের পুরোনো মসজিদটি সিরীয়দের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র। এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মসজিদ।
কীভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠলেন দেশবাসীকে জানালেন জুলানি
কীভাবে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে এইচটিএসের যোদ্ধারা সরকারের পতন ঘটালেন, শুরুতে তার বর্ণনা দেন জুলানি। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যারা দীর্ঘদিন কারাবন্দি ছিলেন, অনেক দুর্ভোগ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এ বিজয় এসেছে।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিজয় বার্তায় ধর্ম-পরিচয় নিয়ে বিভেদ-বিভাজন দূর করার ইঙ্গিত দিয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি সম্প্রদায়ের সদস্য জুলানি। সদ্য সাবেক শাসক আসাদ আলাওয়াত সম্প্রদায়ের। দেশটিতে খ্রিষ্টান, দ্রুজ, শিয়া, ইসমাইলিসহ বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন।
ইরানের সমালোচনা
ভাষণে ইরানের সমালোচনা করেছেন আল-জুলানি। তিনি বলেন, এই বিজয়ের মাধ্যমে এ অঞ্চলের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এতদিন সিরিয়া ছিল ইরানের নানা অভিলাষ পূরণ, গোত্রে গোত্রে সংঘাত ও দুর্নীতি ছড়ানোর ক্রীড়াক্ষেত্র। সিরিয়ার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তেহরানের নাক গলানো বরদাশত করা হবে না– ভাষণে এমন ইঙ্গিতও দেন তিনি। পাশাপাশি, লেবাননে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহকে সিরিয়ার ভূখণ্ডে অবাধ প্রবেশাধিকার ও সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর শাখার প্রতি সমর্থন বন্ধেরও ইঙ্গিত দেন। এর আগে সরকারবিরোধী লড়াইয়ে সব সময় প্রেসিডেন্ট আসাদের পাশে থেকে সহায়তা করেছে ইরান। এ ছাড়া হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা সরাসরি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
বিদ্রোহী নেতা জুলানি জানতেন, তাঁর এ বিজয় ভাষণ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওয়াশিংটন ও তেল আবিব। ‘জঙ্গি’ নেতা হিসেবে তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এই দুই দেশ এক কোটি ডলার পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা স্বীকার করছি, নতুন সিরিয়ার সঙ্গে আপনাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা আছে।’ বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগে তাঁকেও সরিয়ে দেওয়া হতে পারে– বিষয়টি মাথায় রেখেই তিনি এ বক্তব্য দিয়েছেন। বক্তব্যে মাদক নিয়েও কথা বলেন জুলানি। তিনি বলেন, সিরিয়াকে পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ‘মাদকের রাজ্য’ হিসেবে সিরিয়ার যে কুখ্যাতি আছে, তা বদলাতে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ।
নতুন সরকারকে কি বিভিন্ন দেশ স্বীকৃতি দেবে
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, এইচটিএস সমর্থিত নতুন সরকারকে কি বিভিন্ন দেশ স্বীকৃতি দেবে? যুক্তরাজ্য বলেছে, তারা এইচটিএসের বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবে। বিবিসি রেডিও ফোরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা-বিষয়ক কর্মকর্তা প্যাট ম্যাফাডেন বলেন, পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে নতুন শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নির্ধারণ করা হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। জার্মানি বলছে, এইচটিএস নিজেদের ভিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা করছে। তাদের কাজের ওপর ভিত্তি করেই মূল্যায়ন করা হবে।
তবে বাশার আল-আসাদের পতনে সবচেয়ে সুবিধা হয়েছে ইসরায়েলের। আসাদ ইসরায়েলবিরোধী ও ইরান ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পতনের পরপরই রোববার সিরিয়া-ইসরায়েল সীমান্তের ‘বাফার জোন’ দখলে নেয় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। পরে তারা হারমন পর্বতের সিরিয়ার অংশও দখল করে।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে ইসরায়েল। এরপর ১৯৭৪ সালে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি নিয়ন্ত্রণ রেখা প্রতিষ্ঠার চুক্তি হয়। এ চুক্তির পর গত ৫০ বছরে সীমিত অভিযান ছাড়া এ রেখা অতিক্রম করেনি ইসরায়েল। কিন্তু আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেন, ১৯৭৪ সালের চুক্তির আর কার্যকারিতা নেই। বাফার জোন থেকে অগ্রসর হয়ে সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে অবস্থিত হারমন পর্বতের দখল নেন তারা। জেরুজালেম পোস্ট জানায়, হারমন এ সীমান্ত অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু স্থান হওয়ায় এটি সামরিক অবস্থানের বিবেচনায় কৌশলগত সুবিধাজনক।
এর আগে রোববার আসাদের পতনের পর সিরিয়াজুড়ে বিমান হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। সিরিয়ার সরকারি অস্ত্রাগার ও সামরিক স্থাপনাগুলোকে টার্গেট করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তারা ইসলামিক স্টেট বা আইএসের টার্গেটগুলো লক্ষ্য বানিয়েছে। সিরিয়ার সুবাইদা, দারা ও দামেস্কের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা ও অস্ত্রাগারে এসব হামলা হয়েছে। রাজধানী দামেস্কের সায়েন্টিফিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারসহ বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতেও হামলা হয়েছে। পেন্টাগনের বরাত দিয়ে আলজাজিরা জানায়, রোববার সিরিয়ার অন্তত ৭৫টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সবগুলো হামলাই আইএস-অধ্যুষিত অঞ্চলে। এতে বেসামরিক নাগরিকের ক্ষতি হয়নি।
বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। জরুরি এ বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া। এএফপির খবরে বলা হয়, স্থানীয় সময় সোমবার এ বৈঠক হওয়ার কথা।
কারাগারে গোপন কক্ষে স্বজনদের খোঁজ
বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের পর বিভিন্ন কারাগার থেকে বন্দিদের মুক্ত করা হয়। অনেক বন্দির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের স্বজনরা এসেই দামেস্কের সিদনায়াসহ কারাগারে অনুসন্ধান অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। দামেস্কের সবচেয়ে বড় কারাগারের ভেতরে গোপন সুড়ঙ্গ ও কক্ষের সন্ধান মিলেছে।
ব্যাপক চাপে অর্থনীতি
এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের জেরে সিরিয়ার অর্থনীতি বড় ধরনের চাপের মুখে রয়েছে। দেশটির ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।