বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারায় তরুণ লেখকদের মধ্যে অলাত এহ্সান একটি উজ্জ্বল নাম। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘অনভ্যাসের দিনে ‘বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পাঠক ও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ছয় বছর পর বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এতে আরও একটি গল্প যুক্ত হয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে অর্জন প্রকাশন।
গল্পের পটভূমি ও রচনার ধরন
‘অনভ্যাসের দিনে’ এর গল্পগুলোর মধ্যে কাব্যিক ভাবনা, ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং সমাজের গভীর সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। লেখকরচনায় প্রায়শই বাস্তবতা ও বিমূর্ততার মধ্যকার সেতুবন্ধন তৈরি করেন। যেখানে ঘটনাগুলোর ওপর নিরীক্ষা করা হয় গভীর দৃষ্টিতে। তাঁর গল্পে তীক্ষ্ণ সমালোচনা, সমাজের কূপমণ্ডূকতা, শ্রেণিসংগ্রাম এবং মানবিক দুর্বলতাগুলোর মুখোমুখি হওয়া যায়।
বইটির গল্পগুলো সুনিপুণভাবে নির্মিত। লেখক চরিত্রগুলোর মধ্যে এমন এক আত্মবিশ্বাস এবং বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। এটি পাঠককে তাদের নিজেদের জীবনও পুনরায় ভাবতে বাধ্য করে। গল্পের বুননে রয়েছে এক ধরনের দুরূহতা। যা প্রথমবারের মতো পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারে। তবে সময়ের সঙ্গে তা একত্রিত হয়ে আরও সমৃদ্ধ হয়। গল্পের গভীরতা ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাঠককে হতবাক করে তোলে। যার ফলে তাঁর লেখনীকে সত্যিই অনন্য করে তোলে।
বিষয়বস্তু ও ভাষার কৌশল
বইটির গল্পে লেখক সমাজের নানা স্তরের গল্প তুলে ধরেছেন। তার রচনায় আমরা দেখতে পাই, মানুষের স্বপ্ন, আশা, ক্ষোভ, হতাশা, প্রেম, বিশ্বাস – এসব এক সুরেলা একক গল্পে পরিণত হয়েছে। তাঁর ভাষা অতিরিক্ত জটিল নয়, বরং খুব সোজাসাপটা ও গভীর। তিনি এমনভাবে মানুষের মনের সংকট, যন্ত্রণা ও সুখদুঃখের প্রকাশ ঘটান, যে তা একেবারে বাস্তবিক হয়ে ওঠে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে লেখের গল্পগুলোর মধ্যে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ রয়েছে, যেখানে তিনি মানব সম্পর্কের ভেতর-বাহির, ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া ও অনুভূতি বিশ্লেষণ করেন। তাঁর গল্পে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক নানা উপাদান একত্রিত হয়ে একটি সজাগ পাঠকের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ও ব্যবহারিক দক্ষতা যেন গল্পগুলোকে এক রূপক শৈলীতে পরিণত করেছে। এতে পাঠককে এক অনন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে যায়।
গঠন ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ
বইটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জাপানি ভাষার অনুবাদক অভিজিৎ মুখার্জি অলাতের লেখনীর প্রশংসা করেছেন। তিনি তাঁর লেখায় বলেছেন, ‘এহ্সানের চোখ আছে ঘটনা সমষ্টি থেকে গল্পটাকে খুঁজে নেওয়ার,’ এটি সত্যিই গল্পগুলোর ওপর একটি সঠিক মূল্যায়ন। অলাতের গল্পে যে বুদ্ধিদীপ্ত এবং আধুনিক উপস্থাপনার ধাঁচ রয়েছে, তা পাঠককে স্পর্শ করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। গল্পের গঠন যথেষ্ট আধুনিক।
ব্যঙ্গ ও সমাজের প্রতিবিম্ব
এহ্সান তাঁর লেখনিতে সমাজের নানা দিককে ব্যঙ্গের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। তিনি আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দুর্বলতার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। তবে কোথাও গিয়ে পাঠককে নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছেন।
কবি, প্রকাশক সৈকত হাবিব মন্তব্যে বলেন, ‘লেখক ব্যঙ্গচাবুক দিয়ে কেবল সমাজের অভ্যন্তরীণ দিকের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর সমস্যাগুলোকেও সামনে এনেছেন। তিনি যে প্রগাঢ়তা ও সরলতার সঙ্গে এসব সমস্যাকে পাঠক পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।’
একজন গল্পকার
অলাত এহ্সান যে একজন গল্পকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা এই বইটির মাধ্যমে স্পষ্ট। তিনি গল্পের মধ্য দিয়ে শুধু একটি কাল্পনিক কাহিনীর পাশাপাশি মানবজীবনের অঙ্গীকার, নৈতিকতা ও বাস্তবতারও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তাঁর লেখা আমাদেরকে উত্সাহিত করে আমাদের চেতনার গভীরে পৌঁছানোর জন্য। তাঁর গল্পের মাধ্যমে আমরা যে সামাজিক অবস্থা, মানসিক বিপর্যয় এবং সম্পর্কের জটিলতা অনুভব করি, তা পাঠককে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
‘অনভ্যাসের দিনে’ এক রকমের সাহিত্যিক সাফল্য। এটি পাঠকদের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করবে। অলাত এহ্সান যে সাহিত্যের প্রতি নিবেদন রেখেছেন, তা তার গল্পের গভীরতা এবং ভাষার ব্যবহারে প্রতিফলিত হয়েছে। বইটির প্রকাশনা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং এটি বাংলা সাহিত্যের পঙক্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে চলেছে।
বই: অনভ্যাসের দিন
লেখক: অলাত এহ্সান
প্রকাশক: অর্জন প্রকাশন
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
মূল্য: ৩৫০ টাকা