লিটা একটি এতিম মেয়ে। এতিমখানায় বেড়ে ওঠা সেই মেয়েটির বিয়ের আংটি চুরির গল্প শুনুন।
লিটা জন্মের সময় হারিয়েছে মাকে। এরপর সৎ মায়ের জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকা। মাথার ছায়া হিসেবে দাদী বেঁচে থাকলেও তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। দারিদ্র্যতা তাদের পায়ে পায়ে হাঁটে। চাষের জমিজমা বা আয়ের উৎস কিছুই নেই।
লিটার বাবা ছিলো ট্রাক ড্রাইভার। পরিবারের একমাত্র আয়-রোজগারের যোগান দাতা। রোড এক্সিডেন্টে সে বাবাও পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। রেখে যায় স্ত্রী ও তিন মেয়ে সন্তান। মুখের আধার কিছুই রেখে যেতে পারেনি।
সৎ মা তার নিজের দুই মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ীতে পাড়ি জমায়। লিটাকে রেখে যায় দাদির কাছে।
দাদী নাতনীকে নিয়ে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে থাকে। নিজে কি খাবে বা লিটাকে কি খাওয়াবে।
গ্রামের মেম্বার, চেয়ারম্যানের কাছে সাহায্যের জন্য ছুটে যায়। যা কিছু পায় টেনে-টুনে, খেয়ে না খেয়ে রাত-দিন পার করতে থাকে। অবসর সময়ে দাদী মদিনা কপালে হাত রেখে ভাবে না, এভাবে কি দিন চলতে পারে? চারিদিকের অভাবের জগতে কোথায় রাখবে সে পা।
এবার জানুয়ারিতে লিটার বয়স হবে চার। বাড়ির পাশের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছুটে আসে তার স্কেচম্যান এরিয়ার শিক্ষার্থীর নাম তালিকা ভুক্ত করতে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে লিটাকে ভর্তি করে নিবে শিক্ষকরা।
ভর্তি করলেই কি পড়াশোনা করা সম্ভব হবে? গরীবের আবার পড়াশোনা কি? পরের দিনগুলো কীভাবে যাবে? পেটে ভাত নেই। পড়াশোনার খরচ চালাবে কে? কচু পাতার পানির মতো টলমল দাদী-নাতনীর জীবন।
লিটা যতই বড় হবে, তার দৈনন্দিন চাহিদা ততই বাড়বে। একদিন যৌবনের ফুল ফোটবে। তাকে বিয়ে দিতে হবে। জীবন মানে বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। কে পালন করবে এত দায়িত্ব? দাদি কি ছাই দিয়ে মুখ ঢাকতে পারবে?
প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক দাদি মদিনাকে পরামর্শ দেয় লিটাকে সরকারি এতিমখানা/ শিশু পরিবারে ভর্তি করে দেওয়ার জন্য।
ওখানে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, পড়াশোনার সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সেখানে এতিম শিশুদের উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যয়ভার সরকার বহন করে।
নিবাসের অভ্যন্তরে রয়েছে খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, কোচিং শিক্ষার সুব্যবস্থা। আবাসিক সুবিধাও যথেষ্ট মানসম্পন্ন। যা শিশুটি তার পরিবারের সঙ্গে থাকলে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সমাজ সেবা অধিদপ্তর বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি শিশু পরিবারের দেখভাল করে থাকে।
মদিনা তার নাতনির নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সবার পরামর্শ মেনে নেয়। নাতনিকে এতিমখানায় ভর্তি করে দেয়। নিজে রাস্তার পাশে বসে খালি বাটি হাতে ভিক্ষা করে যা পায় তা দিয়ে দিন চলে যায়। তিন কূলে মদিনার কেউ নেই। রাতের বেলায় স্বামীর রেখে যাওয়া কুঁড়ে ঘরে আলো-আঁধারে পড়ে থাকে। শিয়াল-কুকুরে খেয়ে ফেললেও দেখার জন্য কেউ এগিয়ে আসবে না। বাঁশ-জঙ্গল থেকে ছুটে আসা সাপ-বিচ্ছু চারপাশে সব সময় ঘুরতে থাকে। কূপির আলোতে সরায় তার আঁধারের ক্লান্তি।
লিটা নিজেকে শিশু পরিবারের জগতের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। পড়াশোনায়, মেধা, বুদ্ধিতে ভালো দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। নজর কাড়া তার প্রতিভা। ঘোবরের পদ্মফুল ফোটার মতো অবস্থা। আচার-ব্যবহারে নমনীয়তা, চেহারায় কোমলতা, শূন্য জগতে সে একাই একশত।
লিটার বুকে রয়েছে বাবা-মা হারানোর ক্রন্দন। নিজের জীবনের নানা দুশ্চিন্তা। সে বুঝতে পেরেছে পায়ের নিচে মাটি নেই। কূলহারা নৌকার মাঝি সে। একূল ওকূল দুকূলই শূন্য। তারপরও তো জীবন তরী বাইতে হবে। ভাবতে ভাবতে বুক ভিজে যায় জলে।
দাদী যেদিন দেখা করতে আসে, লিটার সে রাতে ঘুম হয় না। আকাশের তারা গুণে-গুণে। লিটার সৎ বোনরা কোথায় কেমন কেমন আছে জানে না। বাবা বেঁচে থাকলে তাদের কপাল চাড়া পাতার মতো জলে ভাসতো না।
চার শতাংশ জায়গার ওপর দাঁড়ানো বাড়ীতে লিটার দাদি বসবাস করে। উত্তরাধিকার সূত্রে তার স্বামীর দুআনা অংশ মদিনা পাবে। লিটা ও তার সৎ বোনেরা কিচ্ছু পাবে না। বাবার অবর্তমানে তাদের চাচাতো ভাইয়েরা পাবে জমির মালিকানা। এটাই আমাদের দেশের প্রচলিত বিধি। এই মেয়েগুলোর কি হবে?
টাকা নেই, অভিভাবক নেই, বাড়ি-ঘরের মালিকানা নেই। এক মহা শূন্যের ভেতর লিটা ও তার সৎ বোনদের অস্তিত্ব। কে দেখাবে তাদের আলোর পথ? কীভাবে খেয়ে পড়ে বাঁচবে?
দেখতে দেখতে সময় এগিয়ে যায় বহু দূর। লিটা এখন অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। পড়াশোনাও তার প্রায় শেষের দিকে। বিধি অনুযায়ী এতিমখানা থেকে তাকে বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ওঠবে কোথায়?
লিটা তার দাদির মাথায় হাত রেখে বলে— দাদি চিন্তা করো না, আল্লাহ একটা গতি করে দিবে।
—না লিটা, আমি তোরে রাখবো কোথায়? তোর বিয়ে দেখে মরতে চাই।
—দাদি, ঘূর্ণাক্ষরে এই কথা মুখে আনবে না। আমি চাকরি করবো। তোমার পরিশ্রমের ঋণ পরিশোধ করতে হবে না? তাছাড়া আমাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে কে? আমার তো নাম, ঠিকানা, পরিচয় নেই। নেই মাথার উপর ছায়া। চেহারায় নাই ঢং-ঢাং। বউ হবার মতো গায়ে-গতরের গঠনে সুন্দর শ্রী কোথায়?
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উচ্চ-কর্মকর্তারা বরাবরই মেয়েটির খোঁজ-খবর রাখতো। পড়াশোনা শেষ করার পর লিটার চাকরির কথা এবার তারা ভাবতে শুরু করে। খোঁজে বের করে কোথায় শূন্য পদ খালি রয়েছে। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর বোদপাড়া উপজেলায় সমাজসেবা কার্যালয়ে একটি শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া হয় লিটাকে। মাথা গোঁজার ঠাই পায় লিটা ও তার দাদি।
রাখে আল্লাহ, মারে কে। গ্রামের কুঁড়ে ঘর ছেড়ে দাদি-নাতনী খুশী মনে লিটার কর্মস্থলে গিয়ে ওঠে। এবার চাল-ডাল একসঙ্গে করতে করতে জীবনের নতুন সুঘ্রাণ খোঁজতে শুরু করে।
মানুষের জীবন কল্পকাহিনীর মতো দুঃখ, ব্যথা, কল্পকাহিনীতে ভরপুর। লেখকের হাতে ধরা পড়লে বিরহের উপন্যাস, নাটক, রম্যকথার জন্ম দেয়। পৃথিবীতে রয়েছে ভুরি-ভুরি তার নজির। মানুষ তো খেলার পুতুল। জানে না সে কী খেলা খেলছে। দম ফুরাইলেই তার খেলা শেষ। লিটাও তার বাইরে নয়।
লিটার জীবনে শুরু হয় আর এক অধ্যায়ের। যুগলবন্দী জীবনের গাঢ় রঙ জমা হতে থাকে কল্পনায়। কেউ কেউ চোখে-ইশারা দেয়। ফ্লাইং কিস ছুড়ে মারে। টেনে নিতে ছায়া ছবির নায়কের মতো লোমশহীন বুকে। আকাশের নীল কেড়ে মেখে দিতে চায় রঙের দুনিয়া চোখে-মুখে।
লিটাও তো রক্তে-মাংসে মানুষ। শিহরণে কেঁপে ওঠে তার সারা অঙ্গ। দাদীকে জড়িয়ে ধরে উড়ায় তার সাত রঙের প্রজাপতির পাখা। বুকের গভীরে লুকানো কল্পনার ভালোবাসার গোলাপ ফুলটা তুলে দিতে চায় মনের মানুষের হাতে। কখনওবা স্বপ্নের ঘোরে হারিয়ে যায় রুমান্টিক জগতে। তারও তো প্রেমের অনুভূতি আছে, সজীব তারুণ্য আছে শরীরের রন্ধ্র কোষের কণায কণায়।
লিটার দাদী বেশ কিছুদিন যাবৎ পীড়াপীড়ি করছে মিটাপুর বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। ছুটির দিনকে সামনে রেখে ছুটে যায় ফেলে আসা জন্ম মাটিতে। সে বাড়িটির স্মৃতি চিহ্ন কিছুই মনে নেই লিটার। বাবাকেও চোখের আয়নায় উদ্দার করতে পারে না।
পৈতৃক ভিটায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশে বহু জন ছুটে আসে সবর আলীর মেয়ে লিটাকে দেখার জন্য। কেউ তাকে চেনে না। সে যেন ওই গ্রহ থেকে ছুটে আসা দৈত্য-দানব এখন।
দাদীর ঘরটি বসবাস করার উপযোগী নয়। লিটার চাচাত ভাই জমি দখল করে ঘর তুলেছে দাদীর ঘরের এক পাশে। তাদের ঘরে দুই রাত্রী যাপন করে লিটা ও তার দাদি ফিরে আসে কর্মস্থলে। সারা গ্রাম ঘুরে সঙ্গে করে নিয়ে আসে বহু সোনালি গেঁয়ো দৃশ্যাবলী। মা-বাবা শূন্য ছায়ার কায়া।
আজকাল বহু প্রস্তাব আসে লিটার বিয়ের জন্য। লিটাকে দেখে নয়। তার হ্যান্ডচাম চাকরির জন্য। তবে বটে বলে লাগে। লিটা বোবা-বধিরের মতো ভাবতে থাকে, বিয়ে করে কী হবে? সবাই তো বিয়ে করেছে। কিন্তু তারা কি সুখী হতে পেরেছে?
আবার সামাজিক প্রথার বাইরে গিয়ে, বিয়ে না করে বাঁচা যাবে কী? দাদির ঘ্যানঘ্যানানিও ভালো লাগে না। দাদির যা স্বাস্থ্যের হাল। সব আশা-ভরসা সাগরে তলিয়ে দিয়ে কবে যে না ফেরার দেশে চলে যায়। তখন কথার পেছনে বহু কথা অপবাদ হয়ে রয়ে যাবে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে যায় লিটা। খোঁজে খোঁজে বরও পাওয়া যায়। দিনক্ষণ ঠিক হয়। কবে কখন কিভাবে বিয়ের ফরমালিটিস রক্ষা করে বউ-বরের হাত দুটোর মিলন হবে।
সিদ্ধান্ত হয় আর কিছু হাতি-ঘোড়া না দিতে পারলেও তো বরকে একটা আংটি দিতে হবে।
আংটি কেনার দায়িত্ব পড়ে চাচাত ভাই কিয়ামত আলীর ওপর। সে খুব বিচক্ষণ, বুদ্ধি-মেধার লোক। তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তার সাহায্যের টাকার একটা অংশ বরাদ্দ রাখা হয় আংটি কেনার জন্য।
কিয়ামত আলী তার বউকে নিয়ে শহরের মার্কেটে যায় আংটি কিনতে। ভালো দোকান থেকে নির্ধারিত বাজেটের ভেতরে বরকে দেওয়ার জন্য আংটি কিনে। হাসি-খুশী মনে বাড়িতে ফেরার পথে রিকশায় রওনা হয়।
কিছু দূর যেতে না যেতেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। ছু মেরে কিয়ামত আলীর বউয়ের ব্যাগটি টেনে নিয়ে যায়। সেই ব্যাগেই ছিলো আংটি।
কিয়ামত আলী এখন কি করবে? মাথায় হাত দিয়ে রাস্তায় বসে কিয়ামত আলী কাঁদতে থাকে।
স্বামীর এ অবস্থায় কিয়ামত আলির বউ তার নিজের কান থেকে দুটো দুল খুলে দিয়ে বলে, ‘যান, বিক্রি করে আংটি কিনে নেন। নিজের মানসম্মান তো রক্ষা করতে হবে।’
এবার আংটি কিনে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে। কোনো কাক-পক্ষী যেন বুঝতে না। রিক্সায় ওঠে আংটি পকেটে মুড়িয়ে বসার সিটের নিচে রেখে দেয়।
একটু দেরী করে হলেও বিয়ে বাড়িতে কিয়ামত আলী ফিরে আসে। এবার তাড়াহুড়ো করে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রিকশা থেকে নেমে যায়। আংটির কথা ভুলে যায়।
রিকশা চালকের কি দোষ? তিনি রিকশায় নতুন যাত্রী তুলার জন্য চলে যায় অন্য পথে। এভাবেই বিয়ের আংটি চুরি হয়ে যায়। অভাগা লিটার ভাগ্য রেখা এভাবেই জিক-জাক পথে চলতে থাকে। অকল্যাণের ভয়ে কল্যাণ সব সময় পালিয়ে বেড়ায়।
এদিকে, ততক্ষণে বিয়ে বাড়িতে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হয় আংটি চুরিকে কেন্দ্র করে। এ বলে এই কথা, ও বলে ওই কথা। কারো মুখ বন্ধ করা যায় না।