লুৎফর রহমান ❑
জাতীয় ঐক্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য: শত প্রতিকূলতার মাঝেও বাঙালি টিকে আছে। তবে বাঙালিকে তার সার্বিক বিকাশের প্রয়োজনে দীর্ঘ সময়ের পরাধীনতার মনোভাব, দাসত্বের মনোভাব বদলাতে হবে। এমন মনোভাবের জন্য বাঙালি প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠতে পারেনি। মূলত তাকে অর্জন করতে হবে স্বাধীন মানুষের চেতনা। তাকে সকল নিন্দিত স্বভাব ত্যাগ করে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। উত্তম চরিত্র, মনুষ্যত্ব, মহত্ব ইত্যাদি গুণে বলিয়ান হয়ে তাকে আদর্শবান হতে হবে। তাকে সুন্দরের জন্য সাধনা করতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। এই চেষ্টার মাধ্যমে বাঙালির লুকনো শক্তি, হারানো শক্তি জেগে ওঠবে এবং তার প্রকৃত আত্মপরিচয় ঘোষণা করবে। বাঙালি পৃথিবীকে নতুন কিছু জানাবে।
বাঙালির নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে, সে মনের মতো না হলে কিছু গ্রহণ করে না, কিছু মানে না। কোনো কিছু জোর করে মানালে পশুশক্তির প্রয়োগ করতে হয়, যা বাঙালির কাম্য নয়। বাঙালি মানবিকতা দেখতে চায়। সাধারণ বাঙালির মধ্যে মনুষ্যত্বের সাধনা বিষয়টি বিদ্যমান। বাঙালিরা যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। ইংরেজ আমল, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ আমল এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই তিন আমলে বাঙালির বিদ্রোহের সাথে যারা বিশ্বাঘাতকতা করে বিজাতি-বিভাষী-বিদেশির সাথে হাত মিলিয়েছে তারাই বাঙালির শত্রু এবং সর্বনাশের জন্য দায়ী। কিন্তু ইতিহাস বলে, বাঙালি পরাজয় মেনে নেয়নি, শাসিত হলেও পরাজয় মেনে নেয়নি। যারা বিদ্রোহ করতে জানে তাদের জয় নিশ্চিত।
একটা জিনিস আমাদের বুঝতে হবে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সবার সংস্কৃতি এক হয় না। ধনীর ও মজুরের-গরিবের-অস্পৃশ্যের-হিন্দুর-বৌদ্ধের-মুসলমানের সংস্কৃতি এক হয় না। এখন প্রশ্ন আসে আমরা কার সংস্কৃতির বিকাশ করবো? মালিক শ্রেণির ও ধর্মব্যবসায়ী, প্রতারক, মিথ্যাবাদীর সংস্কৃতিকে কি আমরা এগিয়ে নেবো? এটা আজ দুনিয়ার সবারই জানা, সংস্কৃতির দুই ভাগ- যথা শোসকের সংস্কৃতি এবং শোষিতের তথা মেহনতি মানুষের সংস্কৃতি। তাহলে আমরা কি নিরপেক্ষ থাকবো? এখানে নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই, নিরপেক্ষতা চিরকাল সুবিধাবাদ, স্বার্থপরতা। মেহনতি মানুষরাই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, আমরা গণতান্ত্রিক বিধান মতে অধিকের সাথে থাকবো তাদের সংস্কৃতির বিকাশ করবো।
আমাদেরকে সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে, আত্মপরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে হবে। বাঙলাভাষী অঞ্চলের এ যাবৎ কালের রাষ্ট্রের বিবর্তনের সঠিক ইতিহাস আমাদেরকে জানতে হবে। আমাদেরকে ইতিহাসের সামনের দিকে ধাবিত হওয়ার গতিকে বোঝতে হবে। সাহসের সাথে উচ্চারণ করতে হবে যে, আমাদের দেহে শেখ-সৈয়দ-কোরেশী-তুর্কী-মোঘল-পাঠানের রক্ত নেই, আর্যরক্তও নেই। আমরা বাঙলাদেশের সন্তান। আমাদের মধ্যে শতকরা সত্তর ভাগ অস্ট্রিক, পঁচিশ ভাগ মোঙ্গল এবং পাঁচ ভাগ রক্ত হাবসী, তুর্কী, মোঘল, আফগান বা ইরানির। এভাবে আমরা শঙ্কর জাতি। আমাদের দেবদেবী, ধর্মচিন্তা, ভাবনা, দর্শন, আচার-অনুষ্ঠান, আধ্যাত্মিকতা সব কিছুর উৎপত্তি আমাদের আপন মাটি থেকে। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলেই আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ সহজ হয়ে যাবে। বাস্তবে মোঘল, পাঠান, তুর্কী, আর্য, এরা কেউই ভারতে এসে তাদের নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা করতে পারে নি। তারা সংখ্যায় ছিলো নগণ্য। এরা আমাদের নিজস্ব সম্পদ সাংখ্য, তন্ত্র, যোগ শুরুতেই গ্রহণ করেছে এবং গ্রহণ না করে উপায় ছিলো না। জন্মান্তরবাদ, প্রতিমা পুজা, মন্দির উপাসনা, পশুদেবতা, বৃক্ষদেবতা ইত্যাদি তারা আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে। তারা শাসক- কিন্তু সংস্কৃতি আমাদের থেকে ধার করেছে। সুতরাং বিদেশীদের পরিচয়ে গর্ববোধ করার কিছু নেই। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের দ্বারা সৃষ্ট- এটাই গৌরবের। কালুরায়, কালুগাজী, বনদেবী, বনবিবি, ওলাদেবী, ওলাবিবি, সত্যনারায়ণ, সত্যপীর সবই বাঙালির সৃষ্ট। বাঙালি মুসলমানের পঁচানব্বই ভাগ হাড়ি, ডোম, বাগদী, চাঁড়াল, মুচি, মেথর থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের দৃষ্টি এখনো আরব-ইরান-ইরাকের মরুভূমিতে ঘুরে। এখান থেকে ফিরে নিজ ভূমিতে আসতে হবে। নিজের পরিচয় গোপন করে অন্যের পরিচয়ে বড় হওয়া যায় না। ঐতিহ্য মূল বিষয় না। গ্রীসের অনেক ঐতিহ্য ছিলো, রোমের অনেক ঐতিহ্য ছিলো, তারা এখন কোথায়? ঐতিহ্যের দরকার নেই। আমরা সব পারবো, সব গড়ে নেবো। আমাদেরকে আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে ফিরতে হবে। আমাদের প্রাচীন ইতিহাস জনপদভিত্তিক রচিত হবে। মধ্যযুগের ইতিহাস হবে অঞ্চলভিত্তিক। আধুনিক যুগের ইতিহাস রচিত হবে বাঙালির জাতিসত্তার বিজ্ঞানসম্মত চেতনা ও পরিচয় ভিত্তিক।
যুগে যুগে আমাদের গণমানুষের বহু আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও গৌরবের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতিসত্তা ঠিক করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করেছে, আমাদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে ডুবতে হবে, মুক্ত হতে হবে সকল প্রকার শোষণ-বঞ্চনা থেকে। ঠিক করে দিয়েছে, আমরা হবো অসাম্প্রদায়িক, বাঙালি জাতি সুন্দরের অন্বেষায় মিশে যাবে দুনিয়ার সাথে, হবে গণতান্ত্রিক এবং মুক্ত হবে সকল শোষণ থেকে। এই মুহূর্তে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক শোষক-শোষিতের সম্পর্ক। উন্নত সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য মানুষে-মানুষে সম্পর্ক হবে সহযোগিতার, সৌহার্দের। এজন্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে সংগঠিত হয়ে মেহনতিদের রাষ্ট্রক্ষমতাকে দখল করতে হবে। মানবিকতা হবে মানুষের ধর্ম। এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠবে নতুন জাতীয় ঐক্য, গড়ে ওঠবে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি।