সমাজের মানুষের ভাবাদর্শ নির্মাণে সিনেমা ও আধুনিক মিডিয়ার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান দুনিয়ায় সিনেমা ও আধুনিক মিডিয়া একটা অঞ্চলের মতাদর্শ নির্মাণ ও রুচি ঠিক করে দিচ্ছে। মানুষ কিভাবে চলবে, কেমন পোশাক পছন্দ করবে নিজের জন্য, তার আচরণ, মানবিক ও অমানবিকীকরণে সিমেমার প্রভাব যথার্থ ক্রিয়াশীল। এতকিছুর পরিসরে সিনেমা নির্মাণে বিভিন্ন ধরণের উদ্দেশ্য থাকে। একক গোষ্ঠী, দেশ ও ব্যক্তি তাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মতাদর্শিক স্বার্থে সিনেমা ও আধুনিক মিডিয়ার ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু সিনেমার উদ্দেশ্য যদি অমানবিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে বর্ণবাদী করা হয় তখন মানব সমাজের প্রতি যে মানবিক দায় ওই দায় থেকে মিডিয়ার অপচ্যুতি ঘটে। মানবিক দায়িত্বের জায়গা থেকে তখন এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
‘আর্টের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব মনে প্রশ্ন জাগানো, উত্তর দেওয়ার আর্ট বড়ঙ এভারেজ ঘটনাই। যখন সিনেমাতে বর্ণবাদ বিষয়কে এড়ানো হয়, তখন সিনেমার যে মানবিক দায়িত্ববোধ তখন এইটাতে সে ফেইল করে।’
জেমস বাল্ডউইন বলেছেন, ‘The purpose of art is to expose the questions, not the answers. When cinema avoids the uncomfortable topic of racism, it fails in its responsibility.’
বর্ণবাদ যা মানুষের গায়ের রঙ, জাতিগত পরিচয় বা জাতিভিত্তিক বৈষম্যমূলক আচরণকে উস্কে দেয়। মানুষের সম্পর্কে আগে অনুমানের (স্টেরিওটাইপ) ভিত্তিতে সামাজিক লাঞ্ছনা ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। বর্ণবাদী সমাজে অবস্থান করেও, একটা দেশের ভূখণ্ডে অবস্থান করা ব্যক্তিকে করে তুলে অপরাপর অস্বীকার করে থাকে তার মানবিক দাবি। বর্ণবাদ যা প্রতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ, অসংবেদনশীল চিত্রায়ণ, জাতিভিত্তিক বিদ্বেষপূর্ণ চরিত্র চিত্রায়ণের মাধ্যমে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে বারবার নেতিবাচক ভূমিকায় উপস্থাপিত করার ফলে ওই গোষ্ঠীর দর্শকরা নিজেদের প্রতি হীনমন্যতা বা লজ্জাবোধ করতে শুরু করে।
দুটি বর্ণবাদী সিনেমার সংক্ষিপ্ত উদাহরণ: Indiana Jones and the Temple of Doom (1984) সিনেমাট স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত এবং জর্জ লুকাস প্রযোজিত একটি অ্যাডভেঞ্চার সিনেমা। সিনেমাটির উৎপাদন খরচ ছিলো আনুমানিক ২৮ মিলিয়ন ডলার। তৎকালীন বক্স অফিস আয়, বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৩৩৩ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। Indiana Jones and the Temple of Doom (1984) সিনেমাটি ১৯৮৪ সালে বক্স অফিস সফল সিনেমা। ওই বছরের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি। সিনেমাটিতে ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একইভাবে এই সিনেমাটি পশ্চিমা বর্ণবাদপুষ্ট। ছবিটিতে ভারতীয় সংস্কৃতি, ধর্ম এবং খাবারের (যেমন বানরের মস্তিষ্ক খাওয়া) অদ্ভুত ও অবমাননাকর উপস্থাপন করা হয়। ওই সিনেমার স্টেরিওটাইপ দিক হচ্ছে ভারতীয়দেরকে অদ্ভুত ও পৈশাচিক খাদ্যাভ্যাসের মানুষ হিসেবে দেখানো হয়, যা ভারতীয়দের প্রতি একটি বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশ করে।
The Toy (1982) ১৯৮২ সালের ১০ ডিসেম্বর মুক্তি পায়। সিনেমাটি সমালোচকদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। এটি প্রায় ৪৭ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার আয় করে, যেখানে নির্মাণ ব্যয় ছিল আনুমানিক ১৭ থেকে ২৮ মিলিয়ন ডলার। সিনেমার গল্পে একজন ধনী শ্বেতাঙ্গ শিশু একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে (রিকর্ড প্রাইয়ার অভিনীত) ‘খেলনা’ হিসেবে কিনে নেয়। ওই সিনেমার মাধ্যমে শোষণের ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে হালকাভাবে উপস্থাপন করা হয়। সিনেমাটিতে শ্রেণি ও বর্ণভিত্তিক বৈষম্যের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোকে সিনেমার কৌতুকময় উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে অবমূল্যায়ন করা হয়, যা বর্ণবাদকে প্রমোট করে।
এছাড়া সিনেমায় ভিলেনকে প্রতিবন্ধী শারীরিক গঠনের উপকরণ হিসেবে যেমন হাত ভাঙা, মুখ পোড়া, এক চোখ অন্ধ, কুৎসিত অপ্রকৃতিস্থ মুখভঙ্গিমা দেখানোর মধ্য দিয়ে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষকে (যাদেরকে অনেকেই প্রতিবন্ধী বলেন) অপর করে দেওয়া হয়। তাদের প্রতি বিরুপ ধারণা, সামাজিক লাঞ্ছনা, অস্বাভাবিক, অশুভ, অলক্ষী, অমঙ্গল দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে এভাবে স্বাভাবিকরণ করা হয়। সিনেমার এই কর্মকাণ্ডে খারাপ লোক কিংবা অশুভ মানেই এমন প্রকৃতির অশুভ শারিরীক গঠন নির্মাণ ও উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সুন্দর সুশ্রী (শ্বেতাঙ্গ কিংবা পশ্চিমা বৈশিষ্ট্যধারী), ভারতীয় অর্থে ব্রাহ্মণ অথবা আরবীয় উচ্চ-বংশের বৈশিষ্ট্যওয়ালা মানুষদের অমানবিক কার্যকলাপকে আড়ালীকরণ করা হয়। এভাবে অশুভের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো যে শুধুমাত্র অস্বাভাবিক শারীরিক গঠনের ব্যক্তিদের মধ্যই প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয়। এই ভাবাদর্শ উৎপাদন সবচেয়ে বেশি করা হয় সিনেমা ও আধুনিক মিডিয়ার মাধ্যমে। অথচ পৃথিবীর গণবিরোধী সব কর্মকাণ্ড, গণহত্যা, মানব সভ্যাতার বর্বরতম ইতিহাসের ঘটনাগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এর পেছনে যারা মাস্টারমাইন্ড তাদের ক্ষেত্রে এরূপ শারীরিক গঠনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব ওই অর্থে তেমন বিদ্যমান নয়।
ভাবাদর্শ হচ্ছে তাই আদর্শিক জায়গার যে অবস্থান ওই অবস্থানের চেয়েও কট্টর বিষয়। ভাবাদর্শের ক্রিয়া ব্যক্তির সমগ্র বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, কারণ ভাবাদর্শ হচ্ছে মনের ওই স্থান যার ওপর নির্ভর করে একজন ব্যক্তি তার সব ধরণের সামাজিক অবস্থান, নৈতিকতা, সম্মান ও শ্রদ্ধার জায়গাগুলোতে ভাবাদর্শ দ্বারা লালিত আচরণগুলো করতে থাকে।
গ্রামীণ সমাজে এমন অনেক প্রবাদ প্রচলিত আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘এডুর ভেতুর তিন শয়তানের নেছুর।’ প্রবাদের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় শয়তান যা খারাপ অর্থে মানুষের মননে একনিষ্ঠ বিশ্বাসে বর্তমান ওই শয়তানের সমকক্ষ করে তোলা হয়েছে অপ্রকৃতিস্থ বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষকে। ‘এন্ডুর ভিতর’ শব্দদ্বয়ের অর্থের যে দ্যোতনা তা মানব মনের ভেতর পঙ্গু বা যেকোনো ফিজিক্যাল ডিজঅর্ডারজনিত মানুষের প্রতি বিরূপ ধারণার জন্ম দেয়। একইসঙ্গে এই সব ধারণা জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একটা গোষ্ঠী-জনতার ওপর, মানব কিংবা মানবীর ওপর সহিংসতা, সামাজিক লাঞ্ছনা-বঞ্চনার রাজনীতিকে বৈধতা দেয়।
এই বঞ্চনা ও সহিংসতার ক্ষেত্রটা কোনপক্ষ নির্ধারণ করবে তা নির্ভর করে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে কারা আছে তার ওপর। মার্কসীয় তত্ত্বে যেমন সব আদর্শ-ভাবাদর্শ সাপ্লাই দেয় উৎপাদন উপকরণ যন্ত্র যাদের হাতে ওই শ্রেণি। তেমনিভাবে এই বর্ণবাদ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে নিম্ন শ্রেণির (প্রলেতারিয়েত) গোষ্ঠীর ওপর আগ্রাসী মনোভাব ও সেই মনোভাবের ফলে সহিংসতা উৎপাদন করে ওই শ্রেণি—যাদের একচেটিয়া অধিকারে রয়েছে অর্থনৈতিক উপকরণ, মিডিয়া ও আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের ওপর। তাই ক্ষমতা যেসব গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করে তাদের হাতেই এর চাবিকাঠি। তারাই বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে বিশেষ করে সিনেমা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক মিডিয়া, মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার করে এসব বর্ণবাদী ভাবাদর্শ তারা উৎপাদন করতে থাকে। উপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদীরা এবং উগ্র জাতীয়বাদীরা এই বিষয়গুলো ব্যবহার করে একটা দেশ ও জাতির ওপর বর্বর, অসভ্য ইত্যাদি তকমা দিয়ে ওই দেশের মানুষকে দাসে পরিণত করেছে। সম্পদ লুট থেকে শুরু করে আধুনিক বিশ্বে ওই সব দেশের জনগণ তাদের স্বাধীনতা পাওয়ার পরও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে নানাভাবে নিগৃহীত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
এর ক্ষেত্র অর্থাৎ এইরকম বর্ণবাদী আচরণের মধ্য দিয়া যে অপরাজনীতি ও অর্থ-রাজনীতি তা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানের মানুষের ওপর কাজ করতে থাকে। যেমন ইভিল বা শয়তানি কর্মকাণ্ড বা শয়তান ধারণা কিংবা শয়তান সম্ভোধনড়—পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি ক্ষোভের অবদমনের প্রতিশোধ হিসেবে এটি পুরুষের ওপরেও আসতে পারে অর্থাৎ এই বিদ্বেষ ব্যবহার হতে পারে। আবার এই শয়তানেরই ফেমিনিন জেন্ডার ‘ডাইনি’ রূপে ফিরে আসতে পারে নারীর ওপর এবং ডাইনি রূপে ফিরে এসে বিভিন্ন সহিংসতার ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করতে থাকে। অথচ শয়তানী কর্মকাণ্ডের একটা শয়তানশুমারী করলে আমরা দেখতে পাবো সমাজ বিদ্যমান নৈতিকতায় যে অমঙ্গল, অশুভ কর্মকাণ্ড তা বিশেষ কোনো বর্ণ, গোত্র, শারিরীক অঙ্গের গঠনের মানুষজনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একীভূত না। এর পেছনে সিনেমা, মিডিয়া ও বাণিজ্যিক মুদ্রণযন্ত্র তাদের হীন ও নোংরা স্বার্থ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুগের পর যুগ ধরে এই টুলসগুলো ব্যবহার করে আসছে।
আগামী দিনের সুন্দর মানবীয় পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের তাই সজাগ ও সমালোচক দৃষ্টি রাখা জরুরি প্রয়োজন। প্রযুক্তির নয়া নয়া উদ্ভাবনের দুনিয়ায় কবি নজরুলের গানের মতো শিকল পরেই শিকল ভাঙতে হবে। সবসময় বর্ণবাদী ও সহিংস আচরণের ক্ষেত্র তৈরির প্রক্রিয়াকে খামোশ বলার সাহস রাখতে হবে আমাদের। সিনেমা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার ও দর্পণ হিসেবে কাজ করে। বর্ণবাদ উপস্থাপন, জাতি বিদ্বেষ এড়িয়ে, যদি একটি সিনেমা সমতা ও জনমানুষের কল্যাণের পক্ষে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে তাহলে সমাজ পরিবর্তনে সিনেমাই হবে প্রধান শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ অক্ষরজ্ঞান না জানা মানুষও সিনেমার ভাব-ভাষা ও সুদূরপ্রসারি গুরুত্ব রঝতে পারে।
তাই নির্মাতাদের দায়িত্বশীলভাবে বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিত। বর্ণবাদী সহিংসতাকে উস্কে দেয় এমন কন্টেন্ট ও উপস্থাপনকে এড়িয়ে সঠিক মূল্যবোধ তুলে ধরা আমাদের মানবিক দায়িত্ব। আমরা যদি এ ধরনের বিষয়গুলোর প্রতি সচেতন হয়ে ওঠি, তাহলে বাণিজ্যিক সিনেমা আমাদের সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।
লেখক: কবি, সমাজ চিন্তক