সোমবার

২৭শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১১ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইরান কি হাইপারসনিক যুগে প্রবেশ করেছে?

ইরান হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিরছ এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বলে দাবি করছে। ২০২৩ থেকে শুরু করে ২০২৫ পর্যন্ত সময়কালে দেশটি ফাত্তাহ-১, ফাত্তাহ-২ ও খোররামশাহর-৪ নামের তিনটি কার্যকর হাইপারসনিক অস্ত্র প্রদর্শন করেছে। এই ঘোষণা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন উত্তেজনা যোগ করেছে। প্রশ্ন উঠছে—ইরানের এই অস্ত্রগুলো সত্যিকারের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, নাকি কৌশলগত চাপ তৈরি করে এক প্রকার ‘কাগুজে বাঘ’ প্রদর্শন?

হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কী?
হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বলতে এমন অস্ত্রকে বোঝায়। যেটা শব্দের গতির পাঁচ গুণের বেশি (ম্যাক ৫+) গতিতে চলতে সক্ষম। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রচলিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মতো সরল পথে চলে না। এটি মাঝপথে গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। এতে সনাক্তকরণ ও প্রতিহত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। হাইপারসনিক অস্ত্র দুইভাবে গঠিত হয়—হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকেল (এইচজিভি) ও হাইপারসনিক ক্রুজ মিসাইল (এইচসিএম)। ইরান মূলত এইচজিভি প্রযুক্তির ওপর জোর দিচ্ছে।

২০২৩ সালে উন্মোচিত ফাত্তাহ-১ একটি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর গতি ম্যাক ১৫ এবং পাল্লা ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। ইরানি কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, এটি বিশ্বের কোনো ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় থামানো যাবে না।

পরবর্তী সময় ফাত্তাহ-২ একটি উন্নত সংস্করণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যাতে মাঝপথে চালচলন করার ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করা হয়েছে।

২০২৫ সালে, ইরান খোররামশাহর-৪ নামের এক নতুন হাইপারসনিক অস্ত্র উন্মোচন করে। এটি ২ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পাল্লা। ১ হাজার ৫০০ কেজি ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। এতে লক্ষ্যনির্ধারণ ও গতিপথ পরিবর্তনের জন্য উন্নত ব্যবস্থা রয়েছে। যেটা বিশেষভাবে ইসরায়েলের আয়রন ডোম, ডেভিডস স্লিং বা আমেরিকার প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রযুক্তিগত বাস্তবতা বনাম রাজনৈতিক বক্তব্য
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাইপারসনিক প্রযুক্তি বিকাশে বিপুল পরিমাণ গবেষণা, পরিশীলিত ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অর্থ প্রয়োজন হয়। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—ইরান কি সত্যিই নিজের সক্ষমতায় এই প্রযুক্তি অর্জন করেছে, নাকি রাশিয়ার সহায়তায়?

ইরানের ঘনিষ্ঠ রুশ যোগাযোগ, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে ড্রোন সরবরাহ ও রাশিয়ার হাইপারসনিক অস্ত্র ব্যবহার অভিজ্ঞতা এই প্রশ্নকে আরও বাস্তব ভিত্তি দেয়। তবে পশ্চিমা বিশ্ব এখনো ইরানের দাবিগুলোকে পুরোপুরি সত্য বলে মেনে নেয়নি।

শক্তির প্রদর্শন না কার্যকর অস্ত্র?
২০২৪ সালে ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে নিক্ষিপ্ত কিছু ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষকে ফাত্তাহ-১ বলে ধারণা করা হয়। এই হামলাগুলোতে বড় কোনো সফলতা পাওয়া যায়নি। ফলে বিশ্লেষকরা বলছেন, এগুলো হয়ত ছিল সামরিক শক্তির প্রদর্শন, কার্যকর আক্রমণ নয়।

কৌশলগত প্রভাব ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা
ইরানের হাইপারসনিক অস্ত্র কৌশলগত দিক থেকে অনেক অর্থ বহন করে। এগুলো শুধু একটি সামরিক উন্নয়ন পাশাপাশি প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রতীক। ইরান জানে, তার প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের তুলনায় সে সামরিক শক্তিতে পিছিয়ে। তাই তাদের কৌশল হলো ‘অসমমিত যুদ্ধনীতি’—অর্থাৎ ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইবার অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা।

এই হাইপারসনিক অস্ত্র শুধু বাস্তব ক্ষতি করতে পারে না। এটি প্রতিপক্ষের মনে ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে। তাত্ত্বিকভাবে, মাত্র ৪০০ সেকেন্ডেই তেহরান থেকে ইসরায়েলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছাতে পারে। এতে প্রতিপক্ষের কাছে প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় কমে আসে এবং ‘প্রথমে হামলা করা’ একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তে পরিণত হয়।

পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া ও নিষেধাজ্ঞা
ইরানের এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির উপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইসরায়েল সরাসরি হুমকি স্বীকার না করলেও তাদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আঞ্চলিক উত্তেজনা আরও বাড়াচ্ছে।

ভবিষ্যৎ কী দেখায়?
ইরান যদি সত্যিকার অর্থে সফলভাবে হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরি করতে পারে এবং তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। তবে এটি মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ভারসাম্যে এক বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এটি শুধু ইসরায়েল পাশাপাশি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এই প্রযুক্তি কেবল সামরিক নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহার হচ্ছে—প্রতিরোধের ভাষা দিয়ে আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানো এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি।

হুমকি নাকি ‘কাগজের বাঘ’?
ইরান সত্যিই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে সক্ষম কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ এখনও থেকেই যায়। প্রযুক্তিগতভাবে তা সম্ভব হলেও, কার্যকর উৎপাদন, স্থায়িত্ব ও নির্ভুলতা অর্জন করা কঠিন।

তবে বাস্তবতা হলো, ইরানের এই পদক্ষেপ কৌশলগতভাবে কার্যকর—এমনকি যদি সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হয়, তবুও এটির উপস্থিতি শত্রুপক্ষকে ‘দ্বিতীয়বার ভাবতে’ বাধ্য করে।

এই মুহূর্তে ইরানের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে আমরা বলতে পারি ‘প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, কৌশলগত হুমকি।’

ইরানের হাইপারসনিক অস্ত্র কতটা কার্যকর, তা ভবিষ্যৎ যুদ্ধক্ষেত্রই বলে দেবে। তবে একথা নিশ্চিত, এই প্রযুক্তির আলোচনাই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা বৃত্তে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

এ বিভাগের আরও সংবাদ

spot_img

সর্বশেষ সংবাদ