দেশ দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত মোড়ে। একদিকে অবকাঠামো উন্নয়ন ও ডিজিটাল অগ্রগতি। অন্যদিকে বাড়ছে বৈষম্য, সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতা। রাজনীতি ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। সামাজিক পরিসর ভীতিপ্রদ। দ্বন্দ্বময় সময়। সামনে আসছে বড় প্রশ্ন। আগামীর দেশ কোন পথে যাবে?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই চোখ পড়ে বাম ও প্রগতিশীল ধারায়। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে কিছু মৌলিক চেতনা ছিল। সেগুলো হল সমতা, ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। এসব চেতনা এসেছে মূলত বাম-প্রগতিশীল আদর্শ থেকে। এখন ওই ধারা দুর্বল, বিচ্ছিন্ন, প্রায় উপেক্ষিত। কিন্তু সময় এসেছে সম্ভাবনা ও করণীয় ভাবার।
দেশের জন্ম প্রগতিশীল স্বপ্ন থেকে। মুক্তিযুদ্ধের চার মূল স্তম্ভ ছিল। সেগুলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এগুলো ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তার মূল ভিত্তি। ১৯৭২ সালের সংবিধান ছিল তার প্রমাণ।
কিন্তু স্বাধীনতার পরে শুরু হল বিচ্যুতি। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক বিপর্যয়। সামরিক শাসনের পর সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির ঝড়। সবকিছু মিলে রাষ্ট্রকে টেনে নিল ভিন্ন দিকে। পুঁজিকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল ধীরে ধীরে স্থান নিল। ধর্ম রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠল। গণতান্ত্রিক চর্চা হল দুর্বল।
এতে বামরা শক্তি হারাল। বাম দলগুলো পুরনো শ্রেণিসংগ্রামভিত্তিক ব্যাখ্যা থেকে বেরোতে পারল না। বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশ ক্ষমতার ছত্রছায়ায় গা ভাসাল। আরেকাংশ হয়ে পড়ল বিচ্ছিন্ন। সময়ের স্রোতে ‘বাম’ ও ‘প্রগতিশীল’ শব্দগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’, ‘উন্নয়নবিরোধী’ ও ‘জাতিবিরোধী’ রঙে রাঙানো হলো।
এখন দেখি এক বিরল দৃশ্য। অর্থনীতি বেড়েছে। শহরে আকাশচুম্বী অট্টালিকা। সড়কে ঝলমলে গাড়ি ও হাতে স্মার্টফোন। কিন্তু আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ বৈষম্য। অল্প কিছু মানুষের হাতে সম্পদ জমা হচ্ছে। লাখো মানুষ বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তার বোঝা বইছে।
গণতান্ত্র সঙ্কুচিত। ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা দিন দিন সংকীর্ণ হচ্ছে। সামাজে সাম্প্রদায়িকতার ছায়া ঘন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঢেউ চাকরির নিরাপত্তাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
এমন বাস্তবতায় বাম-প্রগতিশীল ধারার নতুন করে ওঠে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে। কারণ এই ধারা মূলত বৈষম্যের বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র ও অধিকার রক্ষার পক্ষে। ধর্মনিরপেক্ষতার পথে। তরুণ প্রজন্মের প্রশ্ন। আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়? চাকরি কোথায়? স্বাধীনতা কোথায়? তাদের প্রশ্নই নতুন প্রগতিশীল রাজনীতির সূচনা।
১. আদর্শ ও কৌশলের সমন্বয়
পুরনো মতবাদে আঁকড়ে থাকলে চলবে না। মার্কসবাদী অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ আজও কার্যকর। কিন্তু সেটিকে একবিংশ শতকের ডিজিটাল অর্থনীতি, প্ল্যাটফর্ম কাজ, জলবায়ু সংকটের আলোকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। শ্রমিক, গিগ ইকোনমির রাইডার, ফ্রিল্যান্সার, এমনকি বেকার তরুণদেরও রাজনীতির কেন্দ্রে আনতে হবে। শ্রেণিকে শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। লিঙ্গ, জাতিসত্তা ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটও দেখতে হবে।
২. ভাষা ও যোগাযোগে পরিবর্তন
‘শ্রেণীসংগ্রাম’ বা ‘পুঁজির কর্তৃত্ব’। এমন শব্দ তরুণ প্রজন্মের কাছে দূরের মনে হতে পারে। তাদের কাছে সহজ ও সমকালীন ভাষায় বার্তা পৌঁছাতে হবে। ন্যায্য সুযোগ। অর্থনৈতিক বৈষম্য। সব ধর্মের সমান মর্যাদা। এসব ভাষা সহজবোধ্য। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ভিডিও কনটেন্ট, পডকাস্ট। এসব নতুন প্ল্যাটফর্মে প্রগতিশীল ভাবনা ছড়িয়ে দিতে হবে।
৩. ইস্যুভিত্তিক ঐক্য
বাম দলগুলোর ঐক্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। পরিবেশ আন্দোলন, নারী অধিকার, সংখ্যালঘু অধিকার, ছাত্র আন্দোলন, ভূমিহীন কৃষকের সংগঠন। এসব শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বড় জোট গড়তে হবে। নির্দিষ্ট ইস্যুতে যেমন শিক্ষা বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন। জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবিতে যৌথ কর্মসূচি নিতে হবে।
৪. তরুণ প্রজন্মকে সংগঠিত করা
তাদের হাতে ভবিষ্যৎ। তাদের শক্তি, সৃজনশীলতা, ডিজিটাল দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের শুধু অনুসারী করা যাবে না। সহ-স্রষ্টা হিসেবে দেখতে হবে। চাকরির অনিশ্চয়তা, মানসিক স্বাস্থ্য, সৃজনশীলতার জায়গা। এসব তাদের কর্মসূচির কেন্দ্রে আনতে হবে।
৫. সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার
রাষ্ট্রক্ষমতার আগে সংস্কৃতির ময়দানে জয়ী হতে হয়। সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজ। সবখানে প্রগতিশীল বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধু সমালোচনা করলে হবে না। বিকল্প সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে।
দরকার সম্ভাব্য কর্মসূচি। কৃষক ও শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, প্রগতিশীল করনীতি, সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করা। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করা, বৈশ্বিক তহবিল থেকে ন্যায্য অংশ আদায়, বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়। নারী, সংখ্যালঘু, আদিবাসী, এলজিবিটিকিউ+ জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভাঙা। স্থানীয় সরকার, বিচারব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, ভিন্নমতের জায়গা রক্ষা করা, ডিজিটাল অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিবেশী দেশের সাথে ন্যায্য পানি বণ্টন, বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা, সামরিক জোটের বাইরে সহযোগিতামূলক কাঠামো তৈরি।
দেশ দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণে। একদিকে কর্তৃত্ববাদ, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা; অন্যদিকে সমতা, গণতন্ত্র, সহনশীলতা। পথ বেছে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। বাম-প্রগতিশীল ধারাই দ্বিতীয় পথের দিশা দেখায়। দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক সততা, কৌশলগত ধৈর্য আর নৈতিক সাহস। ব্যর্থতার আশঙ্কায় প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কৃষক জানে, নিষ্ফলা জমিতেও বীজ বোনা যায়। কোন জমিতে অঙ্কুর ফুটবে, তা আগে কেউ বলতে পারে না। আগামীর দেশ গড়তে ওই বীজ বপনের দায়িত্ব বাম-প্রগতিশীলদের।
লেখক: সাংবাদিক

