তিন দশক ধরে অপরাধবোধে পুড়ে যাওয়া, রাতে ঘুম না হওয়া, বারবার শহর পালিয়ে বেড়ানো এক ব্যক্তি অবশেষে মুখ খুলেছেন। ৪৮ বছর বয়সী দলিত ওই ব্যক্তি কর্ণাটকের বেলথাঙ্গডিতে হাজির হয়ে ভারতের অন্যতম ভয়াবহ কথিত অপরাধের তথ্য দিয়েছেন।
স্যানিটেশন কর্মী হিসেবে ধর্মস্থল নামক একটি প্রাচীন মন্দিরে কাজ করা এই ব্যক্তি গত ১২ বছর ছিলেন আত্মগোপনে। ৩ জুলাই তিনি পুলিশকে জানান, ‘অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয় ও অদম্য অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতেই আমি এগিয়ে এসেছি।’
আইনের অধীনে তার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। আদালতে রেকর্ড করা তার বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমি যে খুনের সাক্ষী, যে মৃতদেহ দাফন করেছি, তার ভার আর বইতে পারছি না। যদি না করতাম, আমাকেও কবর দেওয়া হতো।’
‘শত শত মৃতদেহ’—তীব্র অভিযোগ
ধর্মস্থল মন্দির কর্ণাটকের দক্ষিণ কন্নড় জেলার বেলথাঙ্গডিতে অবস্থিত। প্রতিদিন প্রায় ২হাজার ভক্ত এখানে আসেন। অভিযোগকারীর ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে তিনি মন্দিরে কাজ শুরু করেন এবং নদীর ধারে একের পর এক মৃতদেহ দেখতে পান।
‘অনেক মৃতদেহের গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। কিছু দেহে যৌন নির্যাতন ও শ্বাসরোধের চিহ্ন ছিল,’ তিনি জানান। অভিযোগ অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়কেরা তাকে হুমকি দিয়ে মৃতদেহ পুঁতে ফেলতে বাধ্য করত। ‘তারা বলত, যদি কিছু বলি, আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আমার পরিবারকেও ছাড়বে না।’
তিনি বলেন, অনেক সময় দেহগুলো ছিল নাবালিকা মেয়েদের। ‘তাদের গোপনাঙ্গে আঘাত, ছেঁড়া কাপড়, এমনকি অ্যাসিড পোড়ার চিহ্নও ছিল।’ তিনি আরও দাবি করেন, কিছু দেহ পুড়িয়ে ফেলতেও বাধ্য করা হয়েছিল। ‘তারা আমাকে ডিজেল এনে দিত, যাতে দেহ পুরোপুরি পুড়ে যায়, কোনো প্রমাণ না থাকে।’
স্যানিটেশন কর্মীর দাবি অনুযায়ী, ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে শত শত মৃতদেহ এইভাবে নিখোঁজ হয়ে গেছে—যাদের অনেকেই নারী ও শিশু।
২০১৪ সালের পর আত্মগোপনে
মন্দিরে প্রায় ২০ বছর কাজ করার পর ২০১৪ সালে পরিবারসহ তিনি পালিয়ে যান। কারণ তার পরিবারের এক কিশোরী সদস্যকেও মন্দির সংশ্লিষ্ট একজন যৌন হয়রানি করেন বলে তিনি দাবি করেন।
‘আমরা বুঝেছিলাম, আর থাকা যাবে না। তারপর থেকে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, কিন্তু অপরাধবোধ কিছুতেই কাটছে না।’
সম্প্রতি তিনি একটি সমাধিস্থল থেকে কঙ্কাল উত্তোলন করে পুলিশ ও আদালতে জমা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যেকোনো ব্রেন-ম্যাপিং বা পলিগ্রাফ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত। আমি গণকবরের স্থানগুলো চিহ্নিত করতে পারি।’
পুরনো ইতিহাস টেনে আনছে নতুন প্রমাণ
ধর্মস্থলের আশপাশে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ নতুন নয়। ১৯৮৭ সালে ১৭ বছরের পদ্মলতার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় শহরে মিছিল হয়। ২০১২ সালে সৌজন্যা নামের আরেক কিশোরীর ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে ‘জাস্টিস ফর সওজন্যা’ আন্দোলন শুরু হয়।
এই আন্দোলনগুলোর মধ্যেও বারবার ওঠে মন্দির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ—যা শেষমেশ ধামাচাপা পড়ে গেছে বলে দাবি আন্দোলনকারীদের।
মানবাধিকার কর্মী ও সিনিয়র আইনজীবী এস বালান বলেন, ‘ধর্মস্থলে ১৯৭৯ সাল থেকেই নিখোঁজ ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এত বড় অপরাধ আর নেই।’
তিনি আরও জানান, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার সঙ্গে দেখা করে বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে কর্ণাটক সরকার এসআইটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভুক্তভোগীদের পরিবার আবার সামনে আসছেন
২০০৩ সালে নিখোঁজ হওয়া মেডিকেল ছাত্রী অনন্যা ভাটের মা সুজাতা ভাট নতুন করে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই কর্মীর বক্তব্য ও কঙ্কালের ছবি দেখে সাহস পেয়েছি। আমার মেয়েও হয়তো তাদের একজন। তাকে সম্মানের সঙ্গে শেষকৃত্য করতে চাই।’
সুজাতা বলেন, ‘তারা আমাদের বলেছিল প্রশ্ন করা বন্ধ করতে। এত বছর পর আমি শুধু চাই, আমার মেয়ের কঙ্কালটা অন্তত খুঁজে পাই।’
মন্দির কর্তৃপক্ষ কী বলছে?
ধর্মস্থল মন্দির দীর্ঘদিন ধরে হেগড়ে পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমান ধর্মাধিকারী বীরেন্দ্র হেগড়ে, যিনি পদ্মবিভূষণ প্রাপ্ত এবং ভারতের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য।
সৌজন্যার মৃত্যুর পর তার পরিবারও অভিযোগ করেছিল, মন্দির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অপরাধীদের যোগসূত্র রয়েছে।
২০ জুলাই মন্দির কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানায়, ‘আমরা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্ত চাই। জনসাধারণের দায়বদ্ধতা ও সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এসআইটিকে পূর্ণ সহযোগিতা করব।’
মন্দিরের মুখপাত্র কে পার্শ্বনাথ জৈন বলেন, ‘হুইসেলব্লোয়ারের অভিযোগ দেশে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আমরা চাই সত্য বেরিয়ে আসুক।’
আসছে কি বিচার?
এই মুহূর্তে মৃতদেহের সংখ্যা নয়, বরং তাদের সম্মানের সঙ্গে দাফন এবং বিচারই বড় প্রশ্ন। তদন্ত শুরু হয়েছে, আরও কঙ্কাল উত্তোলনের সম্ভাবনা রয়েছে।
এক মানবাধিকার কর্মীর কথায়, ‘শুধু যদি দু-একজন নারীও হয়, তাদের জীবনের মূল্য আছে। বিচার হতেই হবে।’

