রবিবার

২৬শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১০ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাংবাদিকতার এক রুদ্ধশ্বাস অধ্যায়

জুলাই আন্দোলন

জুলাই আন্দোলনের দিনগুলো ছিল আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে রুদ্ধশ্বাস অধ্যায়। প্রতিটি দিন কেটেছে আতঙ্ক, ভয় আর নিরাপত্তাহীনতায়। আমি দৈনিক খবরের কাগজের সহসম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছি। আমার কাজ হচ্ছে ডেস্কে বসে সংবাদ সম্পাদনা করা। জুলাই আন্দোলনের দিনগুলো আমাকে তুমুলভাবে আলোড়িত করে। চারপাশের অস্থিরতা আমাকেও অস্থির করে তোলে।

১ জুলাই শুরু হয় আন্দোলন। এ সময় দেশ চলছিল এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। ১৪ জুলাইয়ের পর পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সেদিন থেকেই নতুন করে শুরু হয় লাগাতার জ্বালাও-পোড়াও, গুম-গ্রেপ্তার, দমন-পীড়ন। বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকারি দলীয় লোকজনের সংঘর্ষ চলছিল। প্রতিদিন খবর আসত— কোথাও না কোথাও লাশ পড়ছে। এক সময় লাশের সংখ্যা দিনে শত ছাড়িয়ে যায়।

রাস্তায় বের হতেই ভয় লাগতো। মনে হতো, বের তো হচ্ছি— বাসায় ফিরতে পারব তো? তবে এ অনিশ্চয়তার মধ্যেও থেমে থাকিনি। সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব ছিল সত্য তুলে ধরা, মানুষের পাশে থাকা এবং দেশের সংকটে নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালন করা। তাই কারফিউ, শাটডাউন—কিছুই আমাকে আটকে রাখতে পারেনি।

কারফিউ চলছিল। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে চলছিল বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল, ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ। ইমেইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সব নিষ্ক্রিয়। পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ প্রায় থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। তবে ছাপা সংস্করণের কাজ থেমে থাকেনি। ইন্টারনেটবিহীন সময়ে ছাপা কাগজই হয়ে উঠেছিল মানুষের একমাত্র নির্ভরতা।

ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ থাকায় জেলা ও উপজেলার সহকর্মীদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করা ছিল কঠিন কাজ। পত্রিকার তৎকালীন প্রধান বার্তা সম্পাদক (বর্তমান ব্যবস্থাপনা সম্পাদক) খালেদ ফারুকী ভাই আমাকে ডেকে সারা দেশের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। ওই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে সফলভাবে পালন করেছি। যেহেতু ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপসহ সব যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ ছিল। তাই মোবাইল ফোনে ক্ষুদেবার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেছি। এই কারণে নিরাপত্তাহীনতা সত্ত্বেও প্রতিদিন আমাকে অফিসে আসতেই হতো।

২০ জুলাই, মধ্যরাত। অফিসের কাজ শেষে রাত দেড়টায় নির্ধারিত সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠি। গন্তব্য—তেজগাঁওয়ের আরজতপাড়া। গাড়িটি বাংলামোটর থেকে বিজয় স্মরণি পৌঁছায়। সেখানে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আমাদের থামায়। তারা জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের রাস্তা বন্ধ। ওই রাস্তায় যাওয়া যাবে না। অটোরিকশার চালক মিলন ভাই গাড়িটিকে ঘুরপথে নিয়ে যান। সাতরাস্তা, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড হয়ে আমতলী রেলগেটের দিকে এগোতে থাকি আমরা। রাত তখন প্রায় পৌনে দু’টা। আমতলী রেলগেটে এসে নামি। মিলন ভাই আমাকে রেখে চলে যান। তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। চারপাশে কেউ নেই। আমি একা। কিছুক্ষণ পর চেকপোস্ট থেকে কয়েকজন সেনাসদস্য এগিয়ে আসেন। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এখানে নামলেন কেন?’ আমি পরিচয় দিই—সংবাদিক। কারফিউ পাস দেখাই। বলি, ‘রেলগেট পার হলেই (আরজতপড়া) আমার বাসা। অফিস শেষে বাসায় যাচ্ছি।’ কিন্তু তারা আমাকে রেলগেট পার হতে দেন না। তাদের মধ্যে এক সৈনিক বলেন, ‘ওই রাস্তায় যাওয়া যাবে না। আপনি পেছনের দিকে যান। মসজিদের পাশ দিয়ে একটি গলি আছে। অনেকে রেললাইন পার হয়ে ওই দিক দিয়ে যাচ্ছে। আপনিও সেভাবেই যান।’ এর মধ্যে বৃষ্টিতে শরীর ভিজে গেছে। ঠান্ডায় কাঁপছি। গলা শুকিয়ে এসেছে। কাঁধে প্রতিদিনের ভারি ব্যাগ, ভিজে আরও ভারি হয়ে গেছে। আমি বাধ্য হয়ে পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করি। উপায় ছিল না, রাস্তায় কোনো গাড়ি চলছিল না। অফিসে ফিরে যাওয়ার সুযোগও ছিল না। আমি হাঁটতে হাঁটতে মহাখালী বাস টার্মিনালের দিকে যাই। একটু এগোতেই পাশে একটি সরু গলি দেখি। গলিটা ধরে হেঁটে রেললাইনে উঠে দাঁড়াই। ঠিক তখনই চোখে এসে পড়ে টর্চের তীব্র আলো। রেলগেটের শেষ মাথা থেকে কয়েকজন চিৎকার করে ওঠে—‘ওই ওই…’।

আমি পাত্তা না দিয়ে দ্রুত রেললাইন পার হওয়ার চেষ্টা করি। হঠাৎ করেই কানে আসে দুটি গুলির শব্দ। রেললাইনের ওপর নির্মিত হয়েছে উড়ালসড়ক। আমি আতঙ্কে দৌড়ে গিয়ে ওই উড়ালসড়কের একটি পিলারের (খুঁটি) আড়ালে দাঁড়িয়ে যাই। তখন বুঝতে পারি, আমার দিকেই গুলি ছোড়া হয়েছে। বারবার টর্চের আলো এসে পড়ছিল আমার ওপর। আমি তখন কী করব, বুঝতে পারছিলাম না।’

পরে সাহস করে পিলারের আড়াল থেকে বেরিয়ে লাইনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াই, যেন গুলিবর্ষণকারী আমাকে স্পষ্ট দেখতে পায়। তখনই আবার একবার গুলির শব্দ! মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সব শেষ। কিন্তু ভয় ছাড়িয়ে একটা আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠছিল মনে—‘যদি গুলি করে মেরে ফেলে, কেউ জানবে না আমি সাংবাদিক। এই মধ্যরাতে সবাই ভাববে, আমি কোনো অপরাধী।’

আমি হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে সামনে রেলগেটের দিকে এগিয়ে যাই। দূর থেকেই বলতে থাকি, ‘আমি সাংবাদিক। অফিস শেষে বাসায় ফিরছি। দয়া করে গুলি করবেন না।’ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে এসে আমাকে ঘিরে ফেলেন। একজন জিজ্ঞেস করে, ‘এতো রাতে এখানে কী করছেন?’ আমি বলি, ‘আমি সাংবাদিক। অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলাম।’ তারা প্রশ্ন করে, ‘আপনি আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন কেন? আমরা নিজেরাই আসতাম। আর একটু হলেই আপনাকে (গুলি করতাম) ফেলে দিতাম।’ আমি বলি, ‘আলো কম, ঠিকমতো কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তাই আমি এগিয়ে এসেছি, যাতে ভুল বুঝে গুলি না করেন।’ পরে তারা আমার ব্যাগ তল্লাশি করেন, পরিচয়পত্র দেখেন। এরপর কিছুক্ষণ কথা বলে আমাকে ছেড়ে দেন।

ওই দিন বাসায় ফিরেও আর স্বাভাবিক হতে পারিনি। আমি এক ধরনের ট্রমার মধ্যে পড়ে যাই। রাতে ঘুমাতে পারিনি। শরীরে তীব্র জ্বর চলে আসে। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ঘটনাটি রাতেই খালেদ ফারুকী ভাইকে মুঠোফোনে জানাই। তিনি বিষয়টি সম্পাদক মহোদয় মোস্তফা কামাল ভাইসহ অফিসের অন্যদের জানান।

পরদিন, ২১ জুলাই। পত্রিকার মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মিন্টু ভূষণ রায় দাদা আমার এমুজন্য আলাদা করে একটি অটোরিকশা পাঠান। অসুস্থ শরীর নিয়েও ওই অটোরিকশাায় করে অফিসে চলে আসি। পরে সম্পাদক মোস্তফা কামাল ভাইকে পুরো ঘটনা বিস্তারিত জানাই। এর দুদিন আগে সহকর্মী, ফটোসাংবাদিক মাসুদ মিলন ভাই গুলিবিদ্ধ হন। পরপর এমন ঘটনায় সহকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। শুধু ২০ জুলাই নয়, পুরো জুলাই মাসজুড়ে আন্দোলনের প্রতিটি দিন ছিল আতঙ্ক আর ভয়ের এক দীর্ঘ পথচলা। ওই পথ পেরোতে গিয়ে আমরা প্রত্যেকে হয়ে উঠেছিলাম একেকজন নীরব যোদ্ধা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

এ বিভাগের আরও সংবাদ

spot_img

সর্বশেষ সংবাদ